ভালোমন্দ খাবার

একটু ভালোমন্দ খাবার কে না খেতে চায়?
আমিও চাই।
 
আমার বাসা থেকে মিনিট ৫চেক দূরত্বে যে স্পেনিশ গ্রোসারী থেকে বাজার-সদাই করি সেটা ২৪-ঘন্টাই খোলা থাকে। ঘুম না আসলে অনেক সময়ই রাত তিনটে সাড়ে তিনটার দিকে সেই দোকানে গিয়ে কিনে নিয়ে আসি আইসক্রিম বা রসালো লাল তরমুজ। এসবের সংগে ঘুমের কোন সম্পর্ক না থাকলেও- একটু খেয়ে বিছানায় গেলেই ঘুম চলে আসে।
 
এমন অনেক রাতও আছে, ঘুম আসছে না।
রিফেজিরেটর খুলি। ঠান্ডা ভাত আর বেচে যাওয়া ঠান্ডা পাতলা ডাল। সংগে অন্য কোন তরকারী থাকুক বা না থাকুক- যা থাকে কপালে- খেয়ে নিয়ে বিছানায় গেলেই ঘুম।
 
এসব কাকতলীয় বা অদ্ভুৎ সব ব্যাপার।
আমেরিকায় আসার পর আমার প্রিয় খাবারের স্বাদগুলি ভুলতেই বসেছিলাম।
 
আমেরিকায় খাবারের কোন অভাব নেই।
 
বরং খাবারের দামই সবচে কম।
আর তাইতো এদেশের বিশেষ করে মেয়েগুলি খেতে খেতে এক একটা পরিণত হয়ে রয়েছে বাচ্চা হাতিতে। বিশেষ করে কালো আর স্পেনিশ মেয়েগুলি তো ভয়াবহ রকমের মোটা। সাবওয়ে ট্রেনে একএক জনের দু’টি পুরো সিটই লেগে যায়।
 
আমেরিকাতে আমার পছন্দনীয় খাবারের মধ্যে যুক্ত হয়েছে আমেরিকান সালাদ উইদ টোনা ফিস অর চিকেন। মন ভরে না কিন্তু পেট ভালোই ভরে।
 
আমি রেড মিট খাইনা বললেই চলে।
 
রেড মিট আর হোয়াইট মিটের বিষয়টা সেদিন জানলাম মাত্র- একটা পিচ্চি মেয়ের কাছে।
এমনিতে তো ফিজিসিয়ানরা অলয়েজ এডভাইস করে রেড মিট এভয়েড করতে।
 
যেসব মাংস সিদ্ধ করার পর সাদা হয়ে যায়- সেটাই হোয়াইট মিট। চিকেন সাদা হয়ে যায়। আর বিফ, পর্ক, মটন হয় লাল।
 
সত্যি বলতে কি খাবারের বিষয়ে এই মহাবিশ্বে চাইনিজ আর বাংলাদেশীরাই সেরা।
 
অবশ্য মেক্সিকানরাও চাইনিজ আর ইন্ডিয়ান দু’টোরই মিশ্রনে এক অনন্য খাবার গোগ্রাসে খেয়ে যাচ্ছে।
 
আমেরিকায় চাইনিজ খাবার সবচে সস্তা আর উচ্চমানের বলেই আমার কাছে মনে হয়। তবে, বাংলাদেশী খাবার অত্যন্ত উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়। এর কারণ সম্ভবত বাংলাদেশীরা অত্যন্ত লোভী আর অপর্চুনেটিষ্টট।
 
২০০৫ এর জুনে ‘সিনো-বাংলা কুটনৈতিক সম্পর্কের ৩০ বছর পূর্তি’ উপলক্ষে চাইনিজ গভর্ণমেন্ট এর আমন্ত্রনে এক রাষ্ট্রিয় সফরে গেলাম চায়নায় ১০ দিনের জন্য। ইউনান, সিচুয়ান আর বেইজিং।
 
সিচুয়ানের খাবারের গল্প তো অনেকবারই করেছি- আজ আর সিচুয়ানের খাবার নিয়ে কিছু বলছি না।
 
যাই হোক সেই দশ দিন তিন বেলা ফাইভ স্টার হোটেলে আমাদের ‘বুফেট’ খাওয়ানো হয়েছে।
 
সকালে ৭টার মধ্যে ব্রেকফাষ্ট।
বিশাল মেনু থেকে ওদের ভুট্টা সিদ্ধ হালকা লবন দিয়ে করা সে এক অমৃত।
 
দুপুরে লান্স কাটায় কাটায় ১২টায়।
দশ দিনের সেই ২০ বেলাটি লান্সে ওরা আমাদের প্রায় ৬৮ রকমের ডাক (হাঁসের মাংসের) মেনু) খাইয়েছে হিসাব কষে। আমি ডাক পছন্দ করি না। লান্সে ওদের ওয়াইনটা বেশ লাগতো।
 
আর বিকেল ঠিক ৪টা বাজলেই আমাদের গাইড টাং হাও বলে উঠতো ‘লেটস গো, ইটস ডিনার টাইম’! তখনও আকাশে সূর্য। সন্ধ্যা হবে আরও ঘন্টা আড়াই পর। কি আর করা!
 
খেয়ে হোটেলে ফেরার পর রাত ১১টার দিকে আবারও ক্ষুধা লেগে যেত। তৃতীয় দিনই আমাদের দল নেতা খালিদ স্যার (তৎকালিন জয়েন্ট সেক্রেটারী) লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে গাইড টাং হাও কে আমাদের ফুড হ্যাবিড আর টাইমিং এর বিষয়টা বোঝানোর পর সে বাকী দিনগুলিতে আমাদের জন্য একটা করে রেডী নুডুলস প্যাকেট এর ব্যবস্থা করে দিত।
 
চাইনিজ খাবার গুলি সত্যিই অনন্যসাধারণ। প্রতিটি খাবারই হেলদী।
নাম না জানা সেই খাবারগুলি এখনও আমার চোখে মুখে ভাসে।
 
আমার প্রিয় খাবারের তালিকাটি খুবই ছোট।
তাজা ছোট মাছগুলি ধনে পাতা, বেগুন, আলু বা ডাটা দিয়ে রান্না করে দিলে আমার আর কিছুই চাই না। তবে, কালাই শাক ভাজিটাও অমৃত।
দেশী মুরগীর মাংস ভুনা হলে একটু বেশীই খেতে পারি। ফলের মধ্যে রাজশাহী অথবা মালদার হিমসাগর আম, দেশী শবরী কলা এসবই।
 
আমেরিকায় আসার পর আমার প্রিয় খাবারগুলি হারিয়েই ফেলেছিলাম। বেঁচে থাকার জন্য নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস্ থেকে মাসে দুই বা একদিন গিয়ে কিছু সবজী আর মাছ নিয়ে আসতাম।
 
অসাধারণ মনোমুগ্ধকর শহর ডালাসেও থাকতে পারিনি শুধুই দেশী খাবারের স্পর্শহীনতার জন্য।
 
মাস কয়েক আগে আমার ছোট আপা ঢাকা থেকে একদিন আমাকে ফোন করে জানতে চাইলেন আমেরিকায় ছোট মাছ আর দেশী মুরগী কোনভাবে পাঠানো সম্ভব কি না?
 
গেল মাসে হঠাৎই একদিন ‘ইত্যাদী’ গ্রসারীতে গিয়েছি বাজার করতে- মাংসের সামনে গিয়ে সাজানো চিকেনের গায়ে লেখা দেখলাম ‘অর্গানিক চিকেন’!
ওয়াও! এতো দেশী মুরগী‍! ডাবল ওয়াও!
 
আমেরিকার অরগানিক চিকেনগুলিই আমাদের দেশী মুরগী। দু’টো নিয়ে এসে খাবার পর বুঝলাম এটা শতভাগই দেশী মুরগী। আর কে পায় আমাকে?
 
ছোট আপা আমার সব লেখাই পড়েন, ‘আপা আমি এখন প্রতি সপ্তাহেই দেশী মুরগী খাচ্ছি, খাবারে আর কোন কষ্ট হচ্ছে না আমার’।
 
আজ গেলাম সকালে একটা বাংলাদেশী রেষ্টুরেন্টে পরাটা কিনতে। প্রায়ই আমি সকালে পরাটা খাই। একটা পরাটা দেড় ডলার।
 
দেশী রেষ্টুরেন্টের ঠিক পাশেই একটা গায়ানিজ গ্রোসারী- গেল মাসে ওপেন করেছে দোকানটি। একদিন ঢুকলাম। কাউন্টারের ছেলেটির নাম রাহিম। রাহিমের পূর্ব পুরুষ ইন্ডিয়া থেকে শতবর্ষ আগে গায়ানায় দেশান্তরী হয়েছিল ভাগ্য বদলে।
 
মজার একটা বিষয় আমি লক্ষ্য করি, ইন্ডিয়ানদের একটা অংশ ভাগ্য বদলের আশায় আজ থেকে এক দেরশ বছর আগেই ইঞ্জিন চালিত নৌকায় সাগর মহাসাগর পাড়ি দিয়ে দল বেধে ছুটে গিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে। তাদের বড় একটা অংশ চলে আসে দক্ষিন আমেরিকার গায়ানায়, কিছু আসে উত্তর আমেরিকায়ও। একটা অংশ গিয়েছে অষ্ট্রেলিয়া আর ফিজিতে। কিছু গেছে ইন্দোনেশিয়ার বালি। আর কালো ইন্ডিয়ান (তামিল) রা গেছে মালয়েশিয়াতে।
 
রাহিমের পূর্ব পুরুষও ওরকমই। সে মুসলিম। তাদের ভাষা বদলে গেছে। ইন্ডিয়ান কালচারও পরিবর্তিত হয়ে গেছে। কিন্তু ফুড হ্যাভিট বা খাদ্যাবাস বদল হয়নি। সে আমাকে বলল, ‘আমরা এখনও বাইগুন খাই, কুমড়ি খাই; প্রায় সব সবজিই উৎপাদন করি নিজেরা কিন্তু মাছ হিসাবে আমরা লাতিন আর সাগরের (সী ফিস) মাছে অভ্যস্ত হয়ে গেছি’।
 
আজ সেই দোকানে একটু টুঁ মেরেছিলাম। হঠাৎই আমার চোখ আটকে গেল বানানার দিকে! একি! এতো শবরী কলা। দেশী শবরী কলা! ঝটপট নিয়ে নিলাম। বাসায় এসেই একটা কলা মুখে দিলাম।
 
হ্যাঁ সেই স্বাদ।
আমার দেশের সেই অরিজিনাল শবরী কলা।
চোখে পানি এসে গেল। দেশী প্রিয় খাবারগুলির জন্যও যে এতো ভালবাসা জমে ছিল- সেটা বুঝতে পারনি।
 
২০০২ সালের দিকে তখন ঢাকাতে আমার নতুন ব্যবসা। ওই সময় আইটি ইকুইপমেন্টগুলিতে আমার ভাল দখল। ঢাকাস্থ সৌদী আরাবিয়ান এম্বাসীর মিলেটারী এটাসে মি. ফাহাদের সংগে আমার এক ফ্রেন্ড আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ফাহাদ সৌদী আরাবিয়া-সহ মিডিলইষ্টে সস্তায় কথা বলার উপায় খুঁজছেন।
 
তখন এক মিনিট কথা বলতে প্রায় ৮৬ টাকা খরচ হতো ফাহাদের। তাকে প্রতিদিন প্রচুর কথা বলতে হতো তাদের পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনার জন্য।
 
আমি তাকে একটা সলিউশন দিলাম।
সে তো মহা খুশী। মাত্র ১৮ টাকায় সে কথা বলতে পারছে। তারপর থেকে প্রায়ই আমাকে ফোন করে। সৌদীতে বেড়াতে নিয়ে যেতে চায়। আরও অনেক কিছু।
 
যাই হোক। একদিন আমাকে সে দাওয়াত দিল- তার সংগে তার বাসায় লান্স করতে হবে।
আমি এক বাক্যে রাজী হয়ে গেলাম।
 
বারীধারার পার্ক রোডে তার বাসা। দোতালায়। কলিং বেল বাজালাম।
গেট খুলে দিল ওদের কাজের মেয়েটি। ফাহাদ সামনে দাঁড়িয়ে। ভাংগা ভাংগা ইংরেজীতে বলল, আমি তোমার জন্য ওয়েট করছি। চলো।
 
ওর ডাইনিং রুমে কোন টেবিল নেই। ফ্লোরে কার্পেটের উপর বসলাম দু’জনে।
 
একটা খুরমা আর এক কাপ ছোট চা দিল। খেলাম।
তখনই একটা ডিসে করে এক প্লেট বাসমতি চালের সুগন্ধযুক্ত ভাত আমাদের সামনে রাখলো সেই কাজের মেয়েটি।
 
ফাহাদ বললেন লেটস স্ট্যাট। বলেই সে হাত দিয়ে সেই ডিস থেকে ভাত খাওয়া শুরু করে দিল। শুধু ভাত।
 
আমি তো অবাক। কি করবো?
ওকে বললাম, আমাকে হাত ধুতে হবে।
ফাহাদ আমাকে বেসিন দেখিয়ে দিল। আমি হাত ধুয়ে এসে দেখলাম, আরও একটা ডিসে একটা আস্ত পোড়া মুরগীর কাবার- দেখতে কালো মিসমিসে।
 
কাবাব আমার চরম অপছন্দনীয় খাবার।
আদিম যুগে অসভ্যরা রান্না জানতো না তাই মাংস পুড়িয়ে খেত। এখন তো আমরা সুসভ্য! এখন কেন পোড়া মাংস খেতে হবে!
 
বিরক্ত হলাম ফাহাদের মেনু দেখে। কি জন্য যে আসলাম?
 
যাই হোক। ফাহাদ খেয়ে যাচ্ছে আর আমাকে খাবার জন্য তাড়া দিচ্ছে।
অগত্যা এক মুঠো ভাত মুখে দিলাম।
 
ওয়াও! এরকম স্বাদের ভাত খেতে তো কোন তরকারীরই প্রয়োজন নাই।
সে কি স্বাদ! এরা ডেইলী এসব খায়? আমি বোকা হয়ে গেলাম।
 
মুহুর্তেই মনে হলো, কাবাব নিয়ে আমার ধারণাও তাহলে সম্ভবত ভুল। ছোট্ট একটু মাংস ছিড়ে মুখে দিলাম। ওহ মাই গড!
 
কাবাব এতটাও মজা হতে পারে!
আমি যাষ্ট ষ্টুপিড হয়ে গেলাম। বাংলাদেশের মানুষ রেষ্টুরেন্টে গিয়ে গোগ্রাসে ডেইল কিসব হাবিজাবি পোড়া মাংস ভক্ষন করে? এরা তো কাবাবের স্বাদই জানে না!
 
একটু পর একটা আস্ত রুই মাছের কাবাব (এটাও কালো মিসমিসে) আসলো। আমি আগা মাথা কিছুই ভাবলাম না। আমি তো ততক্ষনে বুঝেই গেছি যে এটাও অসাধারণ হবে। যদিও রুই মাছ কোন কালেই আমার পছন্দ নয়।
 
কোন কিছু না ভেবে অনেকটা মাছ একবারে মুখে দিলাম। ওয়াও! এ কি খাচ্ছি অামি!
 
শুধুমাত্র মসলা আর রান্নার গুনে যে একটা খাবারকে এতটা অতুলনীয় করে ফেলা সম্ভব- আমার সত্যিই তা জানা ছিল না।
 
আমার জীবনে আমি ঐদিন ফাহাদের বাসায় এক বসায় সবচে বেশী খাবার খেয়েছি তৃপ্তিসহকারে।
 
ফাহাদও মাশাল্লাহ প্রচুর খেতে পারে।
 
শেষ টায় আসলো ফ্রুটস সালাড এবং জিরো ফ্যাটের গরুর দুধ এক গ্লাস করে।
 
ভরা পেটেও স্বাদের কারণে খেতে কষ্ট হলো না।
 
আরেকটা খাবারের কথা বলে বিদায় নিচ্ছি আজ।
 
২০১১ সালে ভারত সরকারের আমন্ত্রণে রাজস্থানের সাবেক রাজধানী উদয় পুরে গিয়েছিলাম ৩ দিনের রাষ্ট্রিয় সফরে।
 
সেই উদয়পুরে আমাদের (ভিআইপি গেষ্টদের) জন্য আলাদা খাবারেরও ব্যবস্থা ছিল যদিও খাবারের মান উল্লেখ করার মতো কোন আলাদা কোন কারণ নেই।
 
কিন্তু।
কিন্তু একটা খাবার এখনও আমার মুখে লেগে রয়েছে। সেটা হলো উদয়পুরের গাজর। কাঁচা গাজর। ওরা খাবারের সংগে সালাদ হিসাবে ওখানকার লম্বা লম্বা গাজর দিতো।
 
সেই কাঁচা গাজরগুলি যে কি অসাধারণ খেতে- তা বলার মতো না।
 
উদয়পুরের গাজরের জন্য হলেও আমি জীবনে আরো কয়েকবার সেই উদয়পুর যাবো।
 
   Send article as PDF