চাপ্টার ফোর

সিসিলিয়া দারুণ একটা মেয়ে।
যতই ওকে দেখছি ততই আমি ওর আচরণে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি।
 
তবে, এবিষয়টাও আমি পরিস্কারই বুঝতে পারছি যে সে অত্যন্ত প্রফেশনাল। ওর দায়িত্বই হচ্ছে আমাকে আগলে রাখা। নতুন পৃথিবীতে আমাকে যতটা সম্ভব স্বাচ্ছন্দ দেয়া। সবকিছু সহজ করে দেয়া।
 
সিসিলিয়া তাই-ই করে যা্চ্ছে এবং অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সংগে।
 
‘তুমি বিয়ে করোনি কেন সিসিলিয়া?’ প্রশ্নটা না করে থাকতে পারলাম না।
 
অবশ্য প্রশ্নটা করার মতো ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা ইতিমধ্যেই আমাদের তৈরী হয়েছে আর সেই যোগ্যতায় ব্যক্তিগত প্রশ্নপূর্ব অনুমতি নেবার প্রয়োজন বোধ করলাম না।
 
ও মিষ্টি করে হেসে দিল। ‘আমাকে বিয়ে করবে তুমি?’
আমিও হেসে দিলাম। ওর রসিকতায় আবারও মুগ্ধ হলাম। সংগে যোগ করলাম, ‘হ্যাঁ, আপাতত করে দেখতে পারি- কি বলো?’
 
দু’জনেই হেসে উঠলাম উচ্চস্বরে।
 
সিটিসেন্টারডিসি শপিং মলটা সত্যিই অসাধারণ। এটাও নাকি আমার মতোই শতাধিক বছরেরই পুরাতন। কিন্তু আমার তো এখানে আগে আসা হয়নি- তাই চিনিও না।
 
আমি সিসিলিয়ার রুচিতে নির্ভর করে বেশ কিছু পোষাক কিনলাম।
নতুন জীবনে এটাই আমার প্রথম শপিং।
 
ওরা নাকি আমার ঠিকানায় ফ্রি হোম ডেলিভারী করবে।
এখন সবকিছুই ড্রোন-ডেলিভারী হয়ে থাকে। শুধুমাত্র বাসার এড্রেসটা ঠিক-ঠাক মতো দিয়ে দিলেই হলো- মেইলবক্সে ড্রপ করে দেবে মুহুর্তেই অত্যাধুনিক ড্রোন-ডেলিভারী সার্ভিস প্রভাইডার কোম্পানীগুলি।
 
সিসিলিয়ার উপর দায়িত্ব পরেছে আগামী ৭দিন আমার সংগে থাকবে। আমাকে কোম্পানী দেবে। আমাকে নতুন পৃথিবী চেনাবে। ফ্যাশন, চলাফেরা সবকিছু। অবশ্য আমি ইতিমধ্যে অনেক কিছুই বুঝে উঠেছি।
 
সিসিলিয়ার ভাষায় আমি নাকি ভেরী ফাষ্ট লার্নার ম্যান।
 
শপিং মলের বাইরেই ‘বার্গার কিং’ রেষ্টুরেন্টটি। আমার এক সময়ের অত্যন্ত পরিচিত ও প্রিয় এই রেষ্টুরেন্ট। সিসিলিয়াকে নিয়ে রেষ্টুরেন্টে ঢুকলাম।
 
ও আমাকে আমার সবকিছুতেই সহযোগীতা করে।
‘কি খাবে সিসিলিয়া?’ প্রশ্ন করলাম।
‘তোমার যা ইচ্ছে হয় আমিও তাইই খাবো, ইভান। সমান সমান অর্ডার করবে- আমি কিন্তু কম খাবো না।’ মেয়েটির মুখে এত হাসি কোথা থেকে আসে আমি বুঝি না।
 
অর্ডার করার সংগে সংগে আমার ‘ওয়ান কার্ডে’ অর্ডার ইনভয়েস চলে আসলো এবং আমিও সংগে সংগে এমাউন্টটা এপ্রোভ করে দিলাম। আমার একাউন্ট থেকে ৬৫.৫৭ ডলার ট্রান্সফার হয়ে গেল, আমি একটা কনফার্মেশন মেসেজ দেখতে পেলাম আমার ওয়ান কার্ডে।
 
ওয়ান কার্ডের কার্যক্রমে আমি মুগ্ধ। এই সামান্য একটা মাত্র কার্ড থাকলে ওয়ালেটে অন্য কোনকিছুই প্রয়োজন হয় না। বাস্তব জীবনের সকল কাজ-কর্ম এই একটিমাত্র কার্ড দিয়েই আমি অনায়াসে চালিয়ে নিতে পারছি।
 
এটাই আমার এটিএম কার্ড, এটাই ক্রেডিট কার্ডস, এটাই মেট্রোকার্ড। এটা দিয়েই আমি কমপিউটারের কাজ কাজ চালাতে পারছি; ফোন পর্যন্ত করছি এই একটা কার্ড দিয়েই।
 
গেল শতাব্দীতে আমার জীবন শেষ হয়ে গেলে- এসব তো দেখা হতো না।
 
এক কোনায় গিয়ে আমরা একটা টেবিলে বসে খাচ্ছি। সেই একই স্বাদ এখনও ধরে রেখেছে এই রেষ্টুরেন্টটি। একই নামে। কত স্মৃতি রয়েছে আমার এই রেষ্টুরেন্টটিকে ঘিরে।
 
ইদানিং স্মৃতিগুলিও আমাকে পেয়ে বসেছে।
সরাক্ষণ শুধুই যা-ই দেখি তারই স্মৃতি সামনে চলে আসে। আর সংগে চোখও ভিজে উঠে। সিসিলিয়ার সামনে এখন লজ্জাও করে চোখে পানি আসাতে।
 
চাইনিজ মেয়ে হেলন গং এর কথাটা মাথায় আটকে রয়েছে।
কি দারুণই না ছিল মেয়েটি। সেটাও তো সেই ২০০১ সালের দিকে কথা হবে! আজকের মতোই ঠিক এভাবে কুয়ালা লামপুরে হেলেনের হাত ধরে ঢুকে ছিলাম ‘বার্গার কিং’ রেষ্টুরেন্টে- ওদিনই ছিল আমার জীবনে প্রথম বার্গার কিং খাওয়া। হেলেন এর অনুরোধে। বিলও হেলেনই দিয়েছিল।
 
খুব বেশী সুন্দরী ছিল চাইনিজ মেয়েটি।
বেশ দুর্বল ছিল সে আমার প্রতি।
 
অথচ, আমি নিজেকে গুটিয়ে নিতাম। সামনে আগানোর মোহ আমাকে পেয়ে বসেছিল তখন!
 
শেষ কবে যেন কথা হয়েছিল হেলেন এর সংগে? হ্যাঁ, প্রায় বছর পাঁচেক পর একদিন হেলেন এর স্কাইপ প্রোফাইলে দেখলাম একটা ছোট্ট কিউট বেবীর ছবি।
 
চোখটা অনেকক্ষন আটকে ছিল সেই বেবীর ছবিতে। হেলেন এর ইচ্ছেকে সম্মান দিলে এই বেবীটা আমারও হতে পারতো তখন।
 
তারপরও তো অনেকবার কথা হয়েছিল হেলেন এর সংগে।
ফোনে কেঁদেছিলও একদিন। অথচ আজ আমার কান্না পাচ্ছে হেলেন এর জন্য।
 
হেলেনের সংগে সম্পর্ক হয়ে গেলে আজ আর আমি এখানে থাকতাম না। এই নতুন পৃথিবী, নতুন মানুষগুলিও দেখার সুযোগ পেতাম না।
 
ব্যক্তিজীবনে একজন সুখী মানুষ হিসাবেই স্ত্রী-পুত্র-কন্যা রেখে আমি ইহলোক ত্যাগ করতাম। হেলেন এর ছেলে-মেয়ে তার ছেলে-মেয়ে কেউ কি বেঁচে রয়েছে?
 
রয়েছে নিশ্চয়ই।
কিন্তু আমি তো তাদের কোন কন্ট্রাক্টস জানি না!
 
আচ্ছা! বিজ্ঞান তো অনেক দূর এগিয়েছে- আমার পুরাতন মেমোরীগুলি কি মুছে ফেলা সম্ভব নয়? অনেকটা হার্ডডিক্স ফরমেট করার মতো করে? সবকিছু যদি ভুলে যেতে পারতাম- তাহলে হয়তো নতুন পৃথিবীতে আবার সবকিছুই নতুনভাবে তৈরী হতো!
 
চিজ-বার্গারে কামড় দিতে দিতে সিসিলিয়াকে প্রশ্নটা করেই ফেললাম, ‘সিসিলিয়া। তোমরা কি আমার মেমোরীটাকে ফরমেট করে আগের সব স্মৃতি ভুলিয়ে দিতে পারো না?’
 
‘কেন?’ সিসিলিয়ার পাল্টা প্রশ্ন।
‘আমার কিছু ভালো লাগছে না। আমি সবকিছুই মনে করতে পারছি। আমার জীবনের সবকিছুই আমি জীবন্ত দেখতে পারছি- অথচ কোন কিছুই এক্সিষ্ট নেই। সবকিছুই ১০০ বছর আগের স্মৃতি। কারো কোন অস্তিত্ব নেই এই পৃথিবীতে- যাকিছু আমার অতি চেনা। আমি কিভাবে বেঁচে থাকবো তুমিই বলো?’
 
‘দেখ ইভান। তুমি যা চাইছো- এটা এখন অত্যন্ত সাধারণ একটা বিষয় বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানের কাছে। কিন্তু আমাদেরকে কিছু সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে হয়। আমরা ক্ষমতা থাকলেও এটার প্রয়োগ করতে পারবো না। সম্ভব না।’
 
রেষ্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে আমরা আমার হসপিটালের রুমে ফিরে আসলাম। খুব টায়ার্ড লাগছিল। একটু ঘুমানো দরকার।
 
কি কি কাজ করা যায়- তা নিয়েও ভাবছি!
আমার কোন কাজ নেই, কাউকে চিনি না এই বিশাল পৃথিবীতে।
 
আমার কোন বন্ধু নেই। নেই পরিবার, পরিচিত অথবা আত্মীয়-স্বজন।
আমি একা। সম্পূর্ণ-ই একা।
 
অবশ্য ইতিমধ্যেই সিসিলিয়াসহ আরো কয়েকজন বন্ধ হয়েছে কিন্তু বুঝতে পারছি এরা সকলেই প্রফেশনাল। এটাকে কোন যুক্তিতেই ব্যক্তিগত সম্পর্ক বলা উচিত হবে না।
 
তাহলে এখন আমার কি করা উচিৎ?
 
ওয়ান কার্ডটি হাতে নিলাম।
প্রজেক্টর এপসটি ওপেন করে সাদা ওয়ালে কমপিউটার মনিটর ভেসে উঠলো। আমার টেবিলের উপর ভার্চুয়াল কি-বোর্ড দেখতে পাচ্ছি।
 
ই-মেইল পাসওয়ার্ডটি মনে আছে। মনে হচ্ছে এই তো সেদিনও লগিন করেছিলাম।
 
হঠাৎই ফেসবুকের কথা মাথায় চলে আসলো। অনেকগুলি ওয়েব ব্রাউজার দেখতে পাচ্ছি। ফেসবুকের এপসও রয়েছে। ফেসবুক রান করলাম। শতবর্ষ আগের ব্যবহৃত আমার ফেসবুক ইউজার পাসওয়ার্ড দিলাম। কিন্তু লগিন হচ্ছে না।
 
বেশ কিছুটা সময় বাদে আমার ডেট অব বার্থ জানতে চাইলো। দিলাম। একটা সিকিউরিটি প্রশ্ন ভেরিফাই চাইলো, পার্ফেক্ট এনসার ইনপুট করলাম।
 
এবার লগিন হলো।
আমার চোখ দিয়ে অঝরো পানি পরছে।
 
নিউজ ফিডে নতুন কোন স্ট্যাটাস নেই।
সর্বশেষ স্ট্যাটাসটি দেখতে পাচ্ছি- সেটাও ২০৮৪ সালের ১২ই ডিসেম্বরের।
 
বাংলায় লেখা, ‘কতদিন ঘুমাই না!’।
 
যাষ্ট এটুকুই। মনে করতে পারছি না ঠিক কে ছিল এই স্ট্যাটাস দাতা। নিজের বেখায়ালেই ‘লভ’ দিলাম স্ট্যাটাসটিতে।
 
নিউজ ফিডের নীচে আর নামতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
নষ্টালজিয়া বড়ই কষ্টকর। অথচ নীচে নামার লোভও সামলাতে পারছি না।
 
কি করবো?
কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলাম।
কি করা উচিত? খুব অসহায় বোধ করছি। আমি জানি ২০২০-২০৩০ এর দিকেও যদি নামি- অনেক পরিচিত বন্ধু, আত্মীয়কে পেয়ে যাবো। তাদের সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাবো।
 
অথচ ওরা আজ আর কেউ-ই এই পৃথিবীতে নেই।
৫০০০ বন্ধুর সকলেই মৃত। ওহ মাই গড!
 
অথচ আমি তো জানিই যে সকলেই মৃত। কিন্তু মানতে পারছি না কেন?
আমাকে তো সবই মানতে হবে। অন্য কোন রাস্তাতো নেই আমার।
 
একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো ভেতর থেকে। আমার অতি পরিচিত শহর-গ্রামের সকলের নাম-চেহারাগুলি আমার সামনে যেন দেখতে পাচ্ছি!
 
এরা কেউ আর নেই আজ। কেউ নেই।
আমি কিছুই ভাবতে পারছি না।
 
মিনিট দশেক চোখ বন্ধ করে রইলাম। আস্তে আস্তে মনকে বোঝাতে পারলাম। শক্ত হলাম। আরও শক্ত।
 
এ জীবন তো আমি নিজেই বেছে নিয়েছি। এর দায়তো শুধুই আমার। তাহলে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছি কেন?
 
আমি আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করবো। শুরু করতেই হবে আমাকে।
 
নতুন শতাব্দীর নতুন মানুষ হয়েই আমাকে এই পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হবে। একটা নতুন কর্ম-পরিকল্পনা আঁকতে হবে।
 
বিক্ষিপ্ত কিছু করা যাবে না আর।
সবকিছুই সুন্দর করে শুরু করবো। অনেক সুন্দর করে।
 
নতুন মানুষ। নতুন জীবন। নতুন পৃথিবী।
শুধু অভিজ্ঞতাই থাকবে শতবর্ষের পুরাতন।
 
তাতে কি?
সবকিছুই আয়ত্ব করে ফেলবো। আমাকে ব্যর্থ হলে তো চলবে না।
 
কাঁধে সিসিলিয়ার হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম। অন্য হাতে টিস্যু দিয়ে নিজেই আমার চোখ মুছে দিল মেয়েটি।
 
‘দেখ ইভান, আমি তোমার কষ্ট অনুভব করি। অামি অনেকবার কল্পনায় তোমার অবস্থানে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিয়ে ভেবেছি। আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু তুমি পেরেছো- অত্যন্ত সাহসী মানুষ হিসাবে। তোমাকে তো ভেংগে পরলে চলবে না। তোমাকে আবারও সব কিছুকে মেনে নিয়ে, মানিয়ে নিয়ে দাড়াতে হবে। এবং তুমি পারবে। আমিও তোমার সংগে রয়েছি। তুমি শুধুই আমার প্যাসেন্ট নও। আমার বন্ধুও। তুমি আমাকে তোমার বন্ধু হিসাবে ভাবতে পারলে আমি গর্বিত হবো। আমাকে বন্ধু করবে না?’
 
সিসিলিয়ার মুখের দিকে তাকালাম। মেয়েটার চোখে জল। আমার জন্য মেয়েটি কাঁদছে।
 
আমার জন্য কাঁদার মতো মানুষ তাহলে এই শতাব্দীতেও আছে!
মানুষের কান্না দেখলেও যে মন ভালো হতে পারে- এই প্রথম বুঝতে পারলাম।
 
সিসিলিয়া নিজের চোখ মুছলো।
 
   Send article as PDF