মীর কাশেমের টাকা

কয়েক মাস আগে ওনি নিউ ইয়র্কে আসলেন।
 
আসার দিন কয়েক আগেই আমাকে ফোন করে জানলেন আমি নিউ ইয়র্কে আছি কি না?
আমার সংগে তার দেখা হওয়া দরকার। কি জরুরী আলোচনা রয়েছে আমার সংগে।
 
আমি ভাবতে লাগলাম।
কি এমন ‘জরুরী আলোচনা’ আমার মতো এই ‘সামান্য অধমে’র সংগে!
 
তিনি আসলেন।
ম্যানহ্যাটনের একটা দামী হোটেলে উঠেছেন তিনি।
 
আমার সেল ফোনে কল দিলেন ঠিক সকাল ১০টায়। আমি সাধারণতঃ অনেক রাত জাগি এবং সকাল ১১টা অবধি ঘুমাই। আমার সেল ফোন সাইলেন্ট মুডে থাকে।
কিন্তু আমার ভিতরে একটা অত্যন্ত মজার বিষয় কাজ করে। এই বিষয়টা বাংলাদেশে থাকতেও দেখতাম। আমার খুব কাছের মানুষরা বিষয়টা জানেও। ধরুন আমার মোবাইলটা পকেটে রয়েছে- সাইলেন্ট মুডে। আমি কখনও ভাইব্রেন্ট একটিভ রাখি না। হঠাৎ আমার মনে হলো কেউ আমাকে ফোন করেছে! এবং আমি সত্যি সত্যি মোবাইলে বের করে দেখতাম কেউ আমাকে কল করছে- রিং হচ্ছে! বিষয়টা অত্যন্ত আশ্চর্য্যজনক! আমি খুব মজা পাই এবিষয়টাতে।
ঠিক ১০টায় আমার ঘুম ভাংলো।
 
মনে হলো কেউ আমাকে কল দিচ্ছে; মোবাইলটা হাতে নিয়ে চোখের সামনে আনলাম, একটা আননোন নাম্বার থেকে (নাম্বারটা নিউ ইয়র্কের) কল এসেছে- রিং বাজতেছে।
 
ফোন ধরলাম। ওপ্রান্ত থেকে পরিচিত এবং ভারী কন্ঠস্বর।
– কেমন আছো বাবা তুমি? বউ মা ভালো?
– আমি হেসে দিলাম। জ্বি মামা। আপনি কেমন আছেন। কখন পৌছলেন নিউ ইয়র্কে?
– ভোড়ে ল্যান্ড করেছে আমাদের বিমান। একটু ঘুম দিয়ে ফ্রেস হয়ে তোমাকে কল দিলাম। কখন দেখা করবে আমার সংগে?
– মামা, আমার ২ ঘন্টা লাগবে; আপনি আপনার হোটেলের নাম ও এড্রেসটা টেক্সট করে দেন। আমি ঠিক ১২টায় আপনার সুইটে পৌছে যাবো।
মামা ফোন কেটে দিলেন।
 
কমপিউটার অন করাই ছিল।
 
মামার হোটেলের এড্রেসটা অনলাইনে দেখে নিলাম। আমাকে ফোর/ ফাইভ/ সিক্স ট্রেনের থার্টিফোর এন্ড লেক্সিনটন এ নামতে হবে তারপর মিনিট পাঁচেকের হাাঁটা পথ।
 
আমি খুব দ্রুত গোসল সেরে, হালকা নাস্তা করে, রেডী হয়ে ম্যানহ্যাটনের উদ্দেশ্যে এক্সপ্রেস ডাউনটাউন সিক্স ট্রেন ধরলাম, ওয়ান হান্ডড্রেড এন্ড টুয়েনটি ফাইভ এ নেমে; ওখান থেকে এক্সপ্রেস ডাউনটাউন ফোর পেয়ে গেলাম। ঠিক পোনে বারটায় মামার সুইটে আমি উপস্থিত হয়ে রিং বাজালাম।
মামা হেসে দিলেন।
 
‘তোমার টাইমিংতো এখন দারুণ। ঢাকাতে টাইমিং ঠিক থাকতো না কেন?’
 
মামার কথায় আমরা দু’জনেই হেসে দিলাম।
 
ঢাকাতে চাইলেও টাইমিং ঠিক রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু আমেরিকায় সবকিছুই ঘড়ির সেকেন্ড মেপে চলে। ‘টাইম’ আমেরিকার সবচে মূল্যবান ‘বস্তু’।
 
যাই হোক; একথা সেই কথা, মামার কিছু জরুরী কেনাকাটা শেষ করে ৪টার দিকে লাঞ্চে বসলাম দুই মামা-ভাগিনা।
 
মামা, বাংলাদেশের বর্তমান আওয়ামী লীগের একজন প্রতিমন্ত্রী। তার নামটা গোপন রাখবো। আমার অনেক লেখাই উনি পড়নে। আমার অনেক লেখারই উনি ভক্ত। প্রায়ই আমার সংগে কিছু আলোচনা আবার উপদেশ দেন; নেনও।
 
আমার নিউ ইয়র্কের বিজনেস এর বিষয়েও খোঁজ খবর নিলেন। কেমন আছি, কেমন অবস্থা এসব বিস্তারিত জানতে চাইলেন। ঢাকায় আমরা অনেক ঘনিষ্ঠ ছিলাম। সেই সূত্রেই এসব ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক আলোচনা।
 
মামা আমাকে এ পর্যায়ে যে কথাটা বললেন- আমি সত্যিই তার জন্য প্রস্তত ছিলাম না।
 
তিনি আমাকে বললেন, বাবা, দেশে ‘বড় একটা টাকা’ আছে। তুমি কিন্তু একটু চেষ্টা করলে নিয়ে আসতে পারবে।
আমি কিছুটা অবাক ও হকচকিয়ে গেলাম। এবং তার ইংগিতটি আমি ধরতে পারলাম না।
– কিসের টাকা মামা? কি প্রজেক্টের? বড় কোন কাজের সুযোগ?
– আরে না। দেশে কাজের সুযোগ কি সবাই পায় নাকি? তুমি বুঝ না দেশের অবস্থা? শেখ হাসিনা, তার ছেলে, মেয়ে আর বোনের বাইরে- কে, কি, করতে পারে? ওরকম সুযোগ থাকলে কি আমি তোমাকে বাংলাদেশ ছেড়ে আমেরিকায় আসতে দিই?
আমি নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। মামার ইংগিত ধরার চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না।
মামাই আবার মুখ খুললেন।
– শোন, মীর কাশেম আলীর তো অঢেল টাকা। তুমি একটু ট্রাই করলে ওখান থেকে ‘ভাল একটা এমাউন্ট’ বের করা ফেলা সম্ভব!
 
আমি এবার সত্যিই ভীষনভাবে অবাক এবং মামার কথায় পুরোপুরি হকচকিয়ে গেলাম।
 
আওয়ামী লীগের ‘বেসিক’ বিষয়টা মাথায় চলে আসলো।
 
এরা যে কতটা সুবিধাবাদী এবং অমানুষ হতে পারে- সেটা ভেবে আমি কিছুক্ষন সত্যিই চুপ হয়ে রইলাম। আরও কিছু গভীর তথ্যের জন্য বললাম, মীর কাসেম অালীকে কোথায় পাবো? সে তো জেলে। আর সে ‘আমাকে’ টাকা দিবেই বা কেন?
 
মামার উত্তর, তুমি টোপ ফেলবে। তার ফাঁসি স্থগতি করার টোপ। সে যে-কোন এমাউন্ট দিতে রাজী হবে।
 
আমি প্রচন্ড বিরক্ত হলাম; কিন্তু বিরক্তিভাবটা মুখে আনলাম না।
শুধু বললাম, আমি এসব বিষয় নিয়ে মোটেও আগ্রহী নই।
 
কিন্তু মামা হাল ছাড়ার পাত্র নন।
 
তিনি আমাকে বললেন, দেখ সুযোগ সব সময় আসে না। আমি জানি তার ফাঁসি স্থগিত করা সম্ভব না। কিন্তু তোমার লেখাতো বিএনপি আর জামায়াতের পক্ষে যায়- নিশ্চয়ই তোমার সংগে ওদের যোগাযোগ হয়। তুমি চেষ্টা করলে কিন্তু সম্ভব।
 
আমি এবার আর মামাকে কোন উত্তর দিলাম না।
শুধু বললাম, মামা এই যে আপনারা পাখির মতোই গুলি করে প্রতিদিন মানুষ মারছেন- এর পরিণতি কি হতে পারে- বুঝেন?
 
মামা হাসলেন।
বললেন, শেখ হাসিনা যেদিন ক্ষমতা থেকে নামবে- সেদিন থেকে বিএনপি আর জামায়াত আমাদের কচু-কাটা করবে। আর তাইতো কানাডায় পরিবারের ইমিগ্রেশন করিয়েই রেখেছি। আমিও দৌড়। অবশ্য আমি রাজনীতি করা মানুষ। কানাডায় করবোই বা কি? দেশের সবকিছু স্বাভাবিক হলে আবার ফিরে যাবো। আর যদি আমেরিকায় আসি- তুমি তো আছোই।
 
আমার আরও একটা মজার বিষয় বলি।
 
বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী আর এমপির সংগে আমার ‘ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা ‘রয়েছে। মজার বিষয়টা হলো- এদের প্রায় সবাইকেই আমি ‘মামা’ ডাকি। এই মামা’রা আমার অনেক কাজে লাগেন। আমাকে ব্যবসায়িক কারণে নিয়মিত ইন্ডিয়া যাবার প্রয়োজন হতো।
 
কিন্তু ইন্ডিয়া আমাকে প্রায় প্রতিবারই হাই কমিশন অফিসে ডেকে, ইন্টারভিউ নিয়ে ভিসা রিফিউজ করতো।
 
এবং ঐ রাতেই আবার ই-টোকেন নিয়ে, ডেট নিয়ে, পরের দিনই সকালে আবার ‘আরেকজন মামা’র প্রতিনিধি হয়ে সেই হাই কমিশন ভবনেই হাজির হতাম। এবং দেখা যেত বেশীর ভাগ সময় আগের দিনের ভিসা অফিসারই আমাকে দেখে একটু রাগত স্বরে বলতেন, ‘ওহ আপনি? ঠিক আছে ৩০০ টাকা দেন।’
 
আমি পাসপোর্ট আর ৩০০ টাকা ওনার হাতে দিয়ে দিতাম; বলতেন বিকেলে এসে ভিসা নিয়ে যাবেন।
 
আমি সত্যিই তৃপ্তির হাসি হাসতাম!
 
এবার মূল ঘটনা বলি।
 
দেশের কথিত আদালতে মীর কাসেম আলী সাহেবের ‘রাষ্ট্রিয় হত্যাকান্ড’ ঘটানোর আদেশটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এর মধ্যেই গত রাতে তার ব্যারিষ্টার ছেলেকে শেখ হাসিনা তার লোকজন দিয়ে তুলে নিয়ে গেল।
 
তার কয়েকদিন আগে তুলে নেয়া হয়েছে হুম্মম কাদের চৌধুরীকেও।
 
আমি বিশ্বাস করি, আমার সেই মন্ত্রী মামা-র মতোই আমাকে দেয়া প্রস্তাবটিই অন্য মন্ত্রী বা হাসিনা নিজে বা কেউ একজন- কাউকে দিয়ে বাস্তবায়ন করার্থেই মীর কাসেম আলীর সাজানো ফাঁসি বিলম্বিত হচ্ছে।
 
তাকে মেরে ফেলা হলে তো আর টাকা হাতানো যাবে না!
 
আওয়ামী লীগ তো ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের সবচে বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান- ইসলামী ব্যাংক খেয়েই ফেলেছে।
 
আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি- গতরাতে মীর আহমেদকে তুলে নেয়া হয়েছে একটাই কারণে। আর সেই কারণটা হলো, এবার ছেলেকে ‘গুম’ করার ভয় দেখিয়ে ‘বড় অংকের কোন চেক’ মীর কাশেম আলীকে দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নেবার জন্যই এই খেলাটা শেখ হাসিনা খেলছে!
 
শেখ হাসিনা সবই পারে।
যেমন সবই পারে ছাত্র লীগ। আওয়ামী লীগ।
 
কিন্তু ছাত্র শিবির সত্যিই একটা বেকুব সংগঠন।
তারা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মৃত্যুদন্ডের রায়ের পর সর্বশক্তি প্রয়োগ করে দেশে ‘হরতাল-অবরোধ-ঝটিকা মিছিল করে’ কিছু্ই করতে পারেনি; বরং তাদের অসংখ্য শক্তিমান নেতাদের হারিয়েছে পুলিশের গুলিতে; নিজেদের সক্ষমতা নষ্ট করেছে।
 
ঐ শক্তি যদি ছাত্র লীগের থাকতো। এবং ছাত্র লীগ যদি বর্তমান শিবির এর মতো অবস্থায় থাকতো- তাহলে ছাত্র লীগ যে কাজটা করতো সেটা হলো- তারা সারা দেশে অরাজকতা না চালিয়ে যাষ্ট বেছে বেছে সুনির্দিষ্ট টাগের্ট নিয়ে কয়েকটা পুলিশ এর শীর্ষ কর্মকর্তা, তাদের পরিবার, কয়েকটা সচিব ও তার পরিবারকে শেষ করে দিত। সম্ভব হলে কয়েকটা মন্ত্রীও।
 
আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ১৫ই ফেব্রুয়ারীতে মাত্র ২/৩ দিনের মধ্যেই খালেদা জিয়াকে তত্ববধায়ক খাইয়ে ছেড়েছে।
 
আওয়াম লীগ ২০০৬ সালে মাত্র কয়েকদিনের আন্দোলনে ‘পাগলা আজিজ’কে নামিয়ে ফেলেছ।
 
বিএনপি-জামায়াত মিলেও আওয়ামী লীগের এক দাঁতের বুদ্ধিও রাখে না।
 
এবং, ছাত্র শিবির- ছাত্র লীগের এক দাঁতের বুদ্ধিও রাখে না।
   Send article as PDF