হাতের ব্যবহার

তখন সম্ভবত ক্লাস নাইন বা টেন এ পড়ি।
 
গ্রামে থাকি।
আমি রাত সাড়ে এগারটা পর্যন্ত পড়াশোনা করতাম।
 
তখনতো আর ডিশ বা স্যাটেলাইট টিভি ছিল না, বিটিভি ছিল একমাত্র ভরসা। তবে, রাত ১১টা, সাড়ে ১১টা নাগাদ আমাদের টিভিতে ইন্ডিয়ান কয়েকটা টিভি চ্যানেল মোটামুটি দেখা যেত। তম্মোধ্যে দুরদর্শন চ্যানেল ছিল অন্যতম। প্রায় প্রতিদিন-ই ওসময় একটা করে কলকাতার বাংলা সিনেমা প্রচারিত হত। বাসার সকলে ঘুমে থাকতো কিন্তু আমি খুব আগ্রহ নিয়ে দেখতাম।
 
ওই সময় ইন্ডিয়ান বিজ্ঞাপনগুলি খুব ভাল লাগতো আমার। তার মধ্যে একটা বিজ্ঞাপন ছিল ‘লাইফবয়’ সাবানের। কথাগুলি পুরোপুরি মনে নেই, তবে অনেকটা নিন্মরূপ: ‘আমাদের ভাগ্য কপালে নয়- শুধুই হাতে’। অদভুৎ লাগতো আমার কাছে কথাগুলি। কি চমৎকার চিন্তা এবং ওই চিন্তাটাই তখন আমার মাথায় পুরোপুরি ঢুকে গিয়েছিল।
 
ওর আরো এক দুই বছর পরের একটা ঘটনা।
একজন (ভদ্র)লোক।
 
সারাটা জীবন ছেলে-মেয়ে নিয়ে অনেক কষ্টে দিন-যাপন করেছেন। অনেক কষ্টে তার দুটি ছেলে একটু পড়াশোনা করে, ঢাকার একটি ফাইভ-ষ্টার হোটেলে চাকুরী পেয়ে গেছে। হাতে কিছু কাচা পয়সা চলে এসেছে। বাড়ীতে সুন্দর ঘর উঠেছে; সবকিছুই সুন্দর-গোছানো, স্বাভাবিক। কিনতু মাঝ পথে একটা গোল বেধে গেল। বাড়ীর সামনে ওনি একটা গেট তৈরী করালেন। এবং মিস্ত্রিদের বললেন- গেটে সুন্দর করে ওনার নাম লিখতে তবে নামের আগে যেন অবশ্যই ‘মরহুম’ কথাটা লেখা থাকে।
 
মিস্ত্রি বলল, আপনি তো মারা যান না নাই, এখনই মরহুম লেখবেন কেন?
ওনি বিরক্ত হয়ে বললেন, যা বলছি করো, তোমরা কি আমার চেয়ে বেশী বুঝ? মিস্ত্রি ভয় পেয়ে নির্দেশ পালন করলো।
 
গেট কমপ্লিট।
কিন্তু এবার সমস্যাটা হলো ওনার এক ভাতিজা লেখাটি ওদিনই দেখতে পেয়ে চাচাকে বিষয়টা ভালভাবে বুঝিয়ে বললে, চাচা ‘মরহুম’ বাদ দিয়ে আবার নতুন করে লিখিয়ে নিলেন।
 
এমন একজন প্রশ্নচিহ্নিত ভদ্রলোক, গ্রামের বলতে গেলে সকলেই তাকে মরহুম নামেই ডাকা শুরু করলো; কেউ তেমন একটা পাত্তা দিত না ওনাকে।
 
যাই হোক সত্যি বলতে কি আমিও বেশীর ভাগের দলেই ছিলাম। ওহ্যাঁ, আমি তখন নিয়মিত নামাজী ছিলাম। মসজিদে আজানও দিতাম, ইমামতিও করাতাম ইমাম সাহেব না থাকলে।
 
হঠাৎ একদিন আমি ওনার বাড়ীর সামনে দিয়ে হেটে যাচ্ছিলাম।
ওনি আমাকে কাছে ডাকলেন। আমি ওনাকে দাদা ডাকতাম, আর ওনি নাতি।
 
‘কেমন আছো, কেমন চলছে পড়াশোনা’ ইত্যাদি কিছু প্রশ্ন করে ওনি আমাকে হঠাৎই বলে বসলেন, ‘আচ্ছা নাতি, বলতো আমরা আল্লাহর কাছে কিভাবে চাই?’
 
সত্যি বলতে কি আমি প্রশ্নটাকে একটু তাচ্ছিল্যের সাথেই নিলাম।
বললাম, ‘কেন’? মোনাজাতের ভংগিতে হাত তুলে দেখালাম এবং বললাম, ‘এভাবে’।
 
ওনি হেসে দিলেন।
তবে, ওনার হাসিটা খুব শক্ত ছিল লক্ষ্য করলাম।
এবং দৃষ্টি আকর্ষণ করা শক্তিশালি একটা হাসি। আমি ওনার দিকে তাকালাম।
 
ওনি মোনাজাতে তোলা হাতদুটিকে ঘুরিয়ে উল্টো করে মাটির দিকে নামিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা এভাবে চাইলে কি লাভ না খুব বেশী ক্ষতি?’
ওনি হাত দুটি কর্মীর হাত হিসাবে উপস্থাপন করলেন বা কাজ করে আদায় করে নেবার বিষয়টি বুঝালেন আমাকে।
 
আমি সত্যিই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম মুহুর্তের জন্য।
আমার ভেতরে সত্যিই সেদিন একটা আমুল পরিবর্তন এসে গিয়েছিল, ওনি এনে দিয়েছিলেন।
 
তারপর থেকে আমার কি যে হল, আমি মহান আল্লাহর কাছে শুধু মনে মনে শক্তি প্রার্থনা করি, আর কিছু না।
 
বাকীটা হাতের ব্যবহার।
 
মন্তব্য: পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের কাছেই অনেক অনেক কিছু শিক্ষার রয়েছে; কাউকে অবহেলা করা উচিৎ নয়; সে আপনার বয়সে ছোট বা বড় যা-ই হোক না কেন?
এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই আমার শিক্ষক।
   Send article as PDF